দলিল নং – ১৩
হযরত নাফে’ (রহ:) বলেন, “আমি হযরত (আবদুল্লাহ) ইবনে উমর (রা:)-কে দেখেছি এক’শ বার বা তারও বেশি সময় মহানবী (দ:)-এর পবিত্র রওযা শরীফ যেয়ারত করেছেন। তিনি সেখানে বলতেন, ‘রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক; আল্লাহতা’লা তাঁকে আশীর্বাদধন্য করুন এবং সুখ-শান্তি দিন। হযরত আবূ বকর (রা:)-এর প্রতিও শান্তি বর্ষিত হোক।’ অতঃপর তিনি প্রস্থান করতেন। হযরত ইবনে উমর (রা:)-কে রওযা মোবারক হাতে স্পর্শ করে ওই হাত মুখে (বরকত আদায় তথা আশীর্বাদ লাভের উদ্দেশ্যে) মুছতেও দেখা গিয়েছে।”— ইমাম কাজী আয়ায (রহ:) কৃত ‘শেফা শরীফ’ গ্রন্থের ৯ম অনুচ্ছেদে বর্ণিত
দলিল নং – ১৪ [হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী (রহ.)-এর ভাষ্য]
ইমাম গাযযালী (রহ:) বলেন এবং এটি কোনো হাদীস নয়:
কারো যখন কোনো অসুবিধা (তথা পেরেশানি) হয়, তখন তার উচিত মাযারস্থ আউলিয়াবৃন্দের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা; এঁরা হলেন সে সকল পুণ্যাত্মা যাঁরা দুনিয়া থেকে বেসাল হয়েছেন। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ-ই নেই, যে ব্যক্তি তাঁদের মাযার যেয়ারত করেন, তিনি তাঁদের কাছ থেকে রূহানী মদদ (আধ্যাত্মিক সাহায্য) লাভ করেন এবং বরকত তথা আশীর্বাদও প্রাপ্ত হন; আর বহুবার আল্লাহর দরবারে তাঁদের অসীলা পেশ হবার দরুন মসিবত বা অসুবিধা দূর হয়েছে।— তাফসীরে রূহুল মা’আনী, ৩০তম খণ্ড, ২৪ পৃষ্ঠা
জ্ঞাতব্য
‘এসতেগাসাহ’ তথা আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রহ:)-এর কাছে সাহায্য প্রার্থনার বিষয়টি সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে আহলুস্ সুন্নাহ’র ওয়েবসাইটের ‘ফেকাহ’ বিভাগে ‘আম্বিয়া (আ:) ও আউলিয়া (রহ:)-এর রূহানী মদদ’ শীর্ষক লেখাটি দেখুন।
দলিল নং – ১৫ [ইমাম শাফেঈ (রহ.)]
ইমাম আবূ হানিফা (রহ:)-এর মাযারে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে ইমাম শাফেঈ (রহ:) বলেন, “আমি ইমাম আবু হানিফা (রা:) হতে বরকত আদায় করি এবং তাঁর মাযার শরীফ প্রতিদিন যেয়ারত করি। আমি যখন কোনো সমস্যার মুখোমুখি হই, তখন-ই দুই রাকআত নফল নামায পড়ে তাঁর মাযার শরীফ যেয়ারত করি; আর (দাঁড়িয়ে) সমাধানের জন্যে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি। ওই স্থান ত্যাগ করার আগেই আমার সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।”
রেফারেন্স
- খতীব বাগদাদী সহীহ সনদে এই ঘটনা বর্ণনা করেন তাঁর কৃত ‘তারিখে বাগদাদ’ গ্রন্থে (১:১২৩)
- ইবনে হাজর হায়তামী প্রণীত ‘আল-খায়রাত আল-হিসান ফী মানাক্কিবিল ইমাম আল-আ’যম আবূ হানিফা’ (৯৪ পৃষ্ঠা)
- মোহাম্মদ যাহেদ কাওসারী, ‘মাক্কালাত’ (৩৮১ পৃষ্ঠা)
- ইবনে আবেদীন শামী, ‘রাদ্দুল মোহতার আ’লা দুররিল মোখতার’ (১:৪১)
জ্ঞাতব্য
এটি সমর্থনকারী দালিলিক প্রমাণ হিসেবে পেশকৃত এবং এটি একটি ’হুজ্জাহ’, কেননা চার মযহাবের অনেক ফুকাহা একে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
দলিল নং – ১৬ [শায়খুল ইসলাম হাফেয ইমাম নববী (রহ.)]
ইমাম সাহেব নিজ ’কিতাবুল আযকার’ পুস্তকের ‘মহানবী (দ:)-এর মোবারক রওযা যেয়ারত ও সেখানে পালিত যিকর’ শীর্ষক অধ্যায়ে লেখেন:
এ কথা জ্ঞাত হওয়া উচিত, ’যে কেউ’ হজ্জ্ব পালন করলে তাকে রাসূলুল্লাহ (দ:)-এর রওযা মোবারক যেয়ারত করতে হবে, ’তা তার গন্তব্য পথের ওপর হোক বা না-ই হোক’; কারণ যেয়ারতে রাসূল (দ:) হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবাদতগুলোর অন্যতম, সবচেয়ে পুরস্কৃত আমল, এবং সবচেয়ে ইপ্সিত লক্ষ্য। যেয়ারতের উদ্দেশ্যে কেউ বের হলে পথে বেশি বেশি সালাত ও সালাম পড়া উচিত। আর মদীনা মোনাওয়ারার গাছ, পবিত্র স্থান ও সীমানার চিহ্ন দৃশ্যমান হওয়ামাত্র-ই সালাত-সালাম আরও বেশি বেশি পড়তে হবে তার; অধিকন্তু এই ‘যেয়ারত’ দ্বারা যাতে নিজের উপকার হয়, সে জন্যে আল্লাহর দরবারে তার ফরিয়াদ করাও উচিত; আল্লাহ যেন তাকে এই যেয়ারতের মাধ্যমে ইহ-জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণ দান করেন, এই কামনা তাকে করতে হবে। তার বলা উচিত, ‘এয়া আল্লাহ! আপনার করুণার দ্বার আমার জন্যে অবারিত করুন, এবং রওযায়ে আকদস যেয়ারতের মাধ্যমে সেই আশীর্বাদ আমায় মঞ্জুর করুন, যেটি আপনি মঞ্জুর করেছেন আপনার-ই বন্ধুদের প্রতি, যাঁরা আপনাকে মানেন। যাঁদের কাছে চাওয়া হয় তাঁদের মধ্যে ওহে সেরা সত্তা, আমায় ক্ষমা করুন এবং আমার প্রতি দয়া করুন।— ইমাম নববী রচিত ‘কিতাবুল আযকার’, ১৭৮ পৃষ্ঠা
দলিল নং – ১৭ [ইবনে কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যা]
(ইবনে কাইয়্যেম ‘সালাফী’দের গুরু। সে তার শিক্ষক ইবনে তাইমিয়্যার ধ্যান-ধারণার গোঁড়া সমর্থক, যার দরুন সে তার ইমামের সেরা শিষ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে)
ইবনে কাইয়্যেম লেখে:
প্রথম অধ্যায় – ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ তাঁদের কবর যেয়ারতকারীদেরকে চিনতে পারেন কি-না এবং তাঁদের সালামের উত্তর দিতে পারেন কি-না?হযরত ইবনু আবদিল বার (রহ:) থেকে বর্ণিত: নবী করীম (দ:) এরশাদ ফরমান, কোনো মুসলমান যখন তাঁর কোনো পূর্ব-পরিচিত ভাইয়ের কবরের পাশে যান এবং তাঁকে সালাম জানান, তখন আল্লাহতা’লা ওই সালামের জবাব দেয়ার জন্যে মরহুমের রূহকে কবরে ফিরিয়ে দেন এবং তিনি সে সালামের জবাব দেন। এর দ্বারা বোঝা গেল যে ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তি যেয়ারতকারীকে চিনতে পারেন এবং তাঁর সালামের জবাবও দিয়ে থাকেন।
বোখারী ও মুসলিম শরীফের বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত আছে, মহানবী (দ:) বদর যুদ্ধে নিহত কাফেরদের লাশ একটি কূপে নিক্ষেপ করার আদেশ দেন। এরপর তিনি সেই কূপের কাছে গিয়ে দাঁড়ান এবং এক এক করে তাদের নাম ধরে সম্বোধন করে বলেন, ‘হে অমুকের পুত্র তমুক, হে অমুকের পুত্র তমুক, তোমরা কি তোমাদের রবের (প্রভুর) প্রতিশ্রুতি সঠিকভাবে পেয়েছো? আমি তো আমার রবের ওয়াদা ঠিকই পেয়েছি।’ তা শুনে হযরত উমর ফারূক (রা:) বল্লেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (দ:), আপনি কি এমন লোকদেরকে সম্বোধন করছেন যারা লাশে পরিণত হয়েছে?’ হুযূর পাক (দ:) বল্লেন, ‘যিনি আমাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর শপথ, আমার কথাগুলো তারা তোমাদের চেয়েও অধিকতর স্পষ্টভাবে শুনতে পেয়েছে; কিন্তু তারা এর উত্তর দিতে অক্ষম।’ প্রিয়নবী (দ:) থেকে আরও বর্ণিত আছে, কোনো ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে দাফন করার পর লোকেরা যখন ফিরে আসতে থাকে, তখন সেই ইন্তেকালপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাদের জুতোর শব্দ পর্যন্ত শুনতে পান।(আল-ফাতহুল কবীর, ১ম খণ্ড, ১৬৯ পৃষ্ঠা)
এছাড়া রাসূলে মকবূল (দ:) তাঁর উম্মতদেরকে এ শিক্ষাও দিয়েছেন, যখন তাঁরা কবরবাসীকে সালাম দেবেন, তখন যেন সামনে উপস্থিত মানুষদেরকে যেভাবে সালাম দেন, ঠিক সেভাবে সালাম দেবেন। তাঁরা যেন বলেন, ‘আস্ সালামু আলাইকুম দারা কাওমিম্ মু’মিনীন।’ অর্থাৎ, ‘হে কবরবাসী মু’মিনবৃন্দ, আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।’ এ ধরনের সম্বোধন তাদেরকেই করা হয় যারা শুনতে পান এবং বুঝতেও পারেন। নতুবা কবরবাসীকে এভাবে সম্বোধন করা হবে জড় পদার্থকে সম্বোধন করার-ই শামিল।
— ইবনে কাইয়্যেম কৃত ’কিতাবুর রূহ’ – রূহের রহস্য, ৭-৮ পৃষ্ঠা, বাংলা সংস্করণ ১৯৯৮ খৃষ্টাব্দ, অনুবাদক – মওলানা লোকমান আহমদ আমীমী
ইবনে কাইয়্যেম আরও লেখে:
হযরত ফযল (রা:) ছিলেন হযরত ইবনে উবায়না (রা:)-এর মামাতো ভাই। তিনি বর্ণনা করেন, যখন আমার পিতার ইন্তেকাল হলো, তখন আমি তাঁর সম্পর্কে খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত ও চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আমি প্রত্যহ তাঁর কবর যেয়ারত করতাম। ঘটনাক্রমে আমি কিছুদিন তাঁর কবর যেয়ারত করতে যেতে পারিনি। পরে একদিন আমি তাঁর কবরের কাছে এসে বসলাম এবং ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে আমি দেখলাম, আমার পিতার কবরটি যেন হঠাৎ ফেটে গেলো। তিনি কবরের মধ্যে কাফনে আবৃত অবস্থায় বসে আছেন। তাঁকে দেখতে মৃতদের মতোই মনে হচ্ছিলো। এ দৃশ্য দেখে আমি কাঁদতে লাগলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রিয় বৎস, তুমি এতোদিন পরে এলে কেন? আমি বল্লাম, বাবা, আমার আসার খবর কি আপনি জানতে পারেন? তিনি বল্লেন, তুমি যখন-ই এখানে আসো, তোমার খবর আমি পেয়ে যাই। তোমার যেয়ারত ও দোয়ার বরকতে আমি শুধু উপকৃত হই না, আমার আশপাশে যাঁরা সমাহিত, তাঁরাও উল্লসিত, আনন্দিত এবং উপকৃত হন। এ স্বপ্ন দেখার পর আমি সব সময় আমার পিতার কবর যেয়ারত করতে থাকি।— প্রাগুক্ত, ৯-১০ পৃষ্ঠা